মেঘনায় মাছ ধরা বন্ধ : লক্ষ্মীপুরের ৫২ হাজার জেলে পরিবার মানবেতর জীবন যাপন

ষ্টাফ রিপোর্টার,লক্ষ্মীপুর-
ষ্টাফ রিপোর্টার,লক্ষ্মীপুর- ষ্টাফ রিপোর্টার,লক্ষ্মীপুর-
প্রকাশিত: ১১:৫৮ অপরাহ্ন, ০৭ মার্চ ২০২৪ | আপডেট: ৮:২৬ পূর্বাহ্ন, ১৯ মে ২০২৪

১মার্চ-থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত নদীতে মাছ ধরা বন্ধ। এ দুই মাস অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষিত লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় এখানকার প্রায় ৫২ হাজার জেলে পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

অন্য কোনো পেশায় সুযোগ না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অলস সময় পার করছেন এসব জেলেরা। অনেকে আবার এই সময়ে জাল মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অপরদিকে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া জেলেদের থেকে ঋণের কিস্তি আদায় করার জন্য এনজিও কর্মীরা প্রতিদিনই জেলেদের কিস্তির টাকা দিতে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মজু চৌধুরী হাট এলাকায় জেলেদের সাথে আলাপকালে জেলে বর্ষা মাঝি (৭৫), সিরাজুল ইসলাম (৭৫), নুরুল ইসলাম (৫৫) নুরনবীসহ (২২) আরও অনেক জেলে জানান, তাদের এই পল্লীতে দুই শতাধিক জেলে পরিবার রয়েছে। তাদের প্রতিটি পরিবারই কোনো না কোনো এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে। কেউ কেউ একাধিক এনজিও থেকেও ঋণ নিয়েছে। জাল ও নৌকা কেনার জন্য তারা এ ঋণ নিয়ে থাকেন। নদীতে মাছ ধরে সে মাছ বিক্রির আয় থেকে তারা ঋণ পরিশোধ করে আসলেও এখন মাছ ধরতে না পারায় তাদের এখন কোনো আয় নেই। আয় না থাকায় তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। অপরদিকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে এনজিও কর্মীরাও কিছুতেই বাড়ি ছাড়ছেন না। ফলে এখন তারা এনজিও কর্মীর আতংকে ভুগছেন।

তারা আরও জানান, সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরে জেলেদের নিয়ে পৃথক মতবিনিময় সভা করেছে জেলা প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ। সভায় নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে এনজিওদের ঋণ কিস্তির টাকা আদায় অতীতের মত বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেয় জেলে ও জনপ্রতিনিধিরা। এ নিয়ে প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও তা এখনো কার্যকর করা হয়নি। ফলে এখন এনজিও কিস্তির টাকা যেন তাদের মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এসব জেলেরা আরও জানান, জেলে কার্ড করার জন্য তারা দুই বছর আগে মৎস্য কর্মকর্তার নিকট কাগজপত্র জমা দিলেও তাদের আজও কার্ড করে দেওয়া হয়নি। অপরদিকে যারা চাল পাবেন তাদের পক্ষে পরিবার পরিজন নিয়ে ৮০ কেজি চাল দিয়ে ৬০ দিন কাটানো অসম্ভব ব্যাপার। ৮০ কেজি চাল কোনো কোনো পরিবারে ২০/২৫ দিনের খাবার। এ ছাড়া শুধু চাল দিয়ে তো আর আহার সারে না। তদুপরি সামনে রমজান মাসের রোজা। কিভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে জেলেরা নিষিদ্ধকালীন দিনগুলো পার করবেন তা তারা ভেবে পাচ্ছেন না।

তারা এ সময় তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য এবং প্রতিটি জেলে পরিবারকে পরিবারের সদস্য অনুযায়ী মাথাপিছু প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।

জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের ৪টি উপজেলায় সরকারি তালিকাভুক্ত ও পরিচয়পত্রধারী জেলের সংখ্যা ৫২ হাজার ৩৫১ জন। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ৭ হাজার ৪৪৬ জন, রায়পুর উপজেলায় ৭ হাজার ৯৯৮ জন, রামগতি উপজেলায় ২৩ হাজার ৯৬৯ জন, কমল নগর উপজেলায় ১২ হাজার ৯৩৮ জন।

নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে নিবন্ধিত জেলেদের মাথাপিছু ৮০ কেজি করে ভিজিএফ’র চাল দিচ্ছে সরকার। এ বছর জেলায় ২৮ হাজার ৩৪৪ জন জেলের জন্য ২ হাজার ২৬৭ দশমিক ৫২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেলেও বাকি ২৪ হাজার ৭ জন জেলের জন্য কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চরর মনী মোহন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউছুফ ছৈয়াল জানান, তার ইউনিয়নে তালিকাভুক্ত জেলের সংখ্যা ৪ হাজার ৫২৫ জন হলেও বরাদ্দ পাওয়া গেছে ২ হাজার ৫০০ জেলের। বাকী ২ হাজার ২৫ জন জেলের জন্য এখনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। বরাদ্দ পাওয়া চাল আগামী ১১ মার্চ স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে বিতরণ করা হবে। তিনি আরও জানান, তালিকার বাইরে তার ইউনিয়নে আরও হাজারের উপরে জেলে আছে যারা কোনো সহায়তা পাবেন না।

চরর মনী মোহন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউছুফ ছৈয়াল বলেন, এমন কোনো জেলে পরিবার পাবেন না; যারা একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নেয়নি। সপ্তাহে দুই-তিনটা করে তাদের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। আমি নিজেও নিষেধাজ্ঞাকালীন এনজিও ঋণ কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার জন্য প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়ে এসেছি। কিন্ত তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আমি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রতিটি জেলেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাই।

এদিকে জেলেদের তালিকায় ভুয়া জেলে রয়েছে দাবি করে জেলা মৎস্যজীবী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তফা ব্যাপারি বলেন, জেলে তালিকা করার সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ জেলে না হওয়া সত্বেও তাদের অনেক আত্মীয়স্বজনকে জেলে তালিকাভুক্ত করে নিয়েছে। যাদের অনেকেই এ পেশার সাথে কখনো জড়িত ছিলেন না এবং এখনও নেই। অপরদিকে মেঘনার প্রকৃত জেলে হওয়া সত্বেও জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা  এবং নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ভোলা, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন জেলা থেকে লক্ষ্মীপুর জেলায় এসে বসবাসকারী জেলেদের স্থানীয় বাসিন্দা না হওয়া এবং নদীতে ভাসমান নৌকায় বসবাসকারি বেদে ও বৈরাল গোত্রের জেলেদের কোন স্থায়ী ঠিকানা না থাকাসহ নানা কারণে হাজার হাজার জেলেকে তালিকাভুক্ত করা হয়নি।

তিনি নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে জেলেদের থেকে এনজিও ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ এবং প্রকৃত জেলেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মজু চৌধুরীর হাট নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. আবু তাহের বলেন, জেলেদের কোনোভাবেই নদীতে নামতে দেওয়া হবে না।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, নদীতে দুই মাস মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় জেলেরা ভিজিএফের আওতায় দুই কিস্তিতে জনপ্রতি ৮০ কেজি করে করে চাল পাচ্ছেন। বেশিরভাগ এলাকায় চাল বিতরণ শেষ পর্যায়ে।

জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রিয়াঙ্কা দত্ত বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের থেকে ঋণের কিস্তি না নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলা হবে। সকলের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।