বিলুপ্ত হচ্ছে পদ্মা ব্যাংক, চলবে এক্সিম ব্যাংকের নামে। চাকরি ও যাবে না কর্মীদের

অর্থনৈতিক ডেস্ক-
অর্থনৈতিক ডেস্ক- অর্থনৈতিক ডেস্ক-
প্রকাশিত: ৫:১৮ পূর্বাহ্ন, ১৯ মার্চ ২০২৪ | আপডেট: ৫:৩৬ পূর্বাহ্ন, ১৯ মে ২০২৪

দেশে প্রথমবারের মতো একীভূত হচ্ছে দুই ব্যাংক। ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে প্রচলিত নিয়মে পরিচালিত পদ্মা ব্যাংক। ফলে বিলুপ্তির মুখে পড়েছে ব্যাংকটি।  এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতের দুটি ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সই হয়েছে। সোমবার (১৮ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে এই চুক্তি হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আফজাল করিম।

সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর পরবর্তী অনুষ্ঠানে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, আগামীকাল থেকে আর পদ্মা ব্যাংক থাকছে না। ব্যাংকটিকে একীভূত করার কারণে নতুন কার্যক্রম চলবে এক্সিম ব্যাংকের নামে। একীভূত করা হলেও কোনো এমপ্লয়ি চাকরি হারাবেন না। তবে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালকরা এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন না। তবে দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।

নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, পদ্মা ব্যাংকে একীভূত করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো চাপ ছিল না, তবে সরকারের পক্ষ থেকে পরামর্শ ছিল। আমরা এটা করেছি দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে। পদ্মাকে একীভূত করা হলেও আমানতকারীদের কোনো সমস্যা হবে না, সবাই নিরাপদে থাকবেন।

এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, বিশ্বে দুই পদ্ধতিতে ব্যাংক একীভূত করা হয়। আমরা একুইজিশন করিনি, মার্জ করেছি। একটা সবল ব্যাংক এবং তুলনামূলক একটু দুর্বল ব্যাংকের মধ্যে মার্জ হয়েছে। পদ্মা ব্যাংকের মানবসম্পদ যেটা রয়েছে প্রায় ১২০০ কর্মী তাদের কারও চাকরি যাবে না। সবাই কর্মরত থাকবেন এক্সিম ব্যাংকের হয়ে। আমাদের আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ক্ষতি হবে না। আগের মতোই চলবে।

পরিচালক প্রসঙ্গ তিনি বলেন, যে ব্যাংকটি দুর্বল (পদ্মা) তারা সবল ব্যাংকের (এক্সিম) সাথে আর বসবেন না। যেহেতু এক্সিম পদ্মাকে মার্জ করেছে, এটা আজকে থেকে বা কাল থেকে পদ্মা ব্যাংক পুরোটা এক্সিম ব্যাংক হয়ে গেল। তবে এমডি বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তারা দুজনই ডায়নামিক, আমরা চেষ্টা করব একটা ভালো সম্মাননীয় অবস্থানে তাদের রাখতে।

যদি নেট এসেট ভ্যালু নেগেটিভ থাকে তবে এটার দায়িত্ব কে নেবে? যদি এক্সিম ব্যাংক দায়-দায়িত্ব নেয় তবে শেয়ার হোল্ডাররা ঠকবে না?
আবু আহমেদ, অর্থনীতির অধ্যাপক, ঢাবি

পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পৌনে চার হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি ব্যাংকের দায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা রয়েছে পদ্মার কাছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এখন যেহেতু পদ্মাকে মার্জার করা হলো এর ফলে পদ্মা ব্যাংকের সব দায়-দেনা এখন এক্সিম ব্যাংক নিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া দুই ব্যাংকের এসেটও আছে। এক্সিম যেহেতু পদ্মার জাল ফেলেছে আশা করছি আরও সবল হবে অর্থনীতি।

শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক্সিম ব্যাংক শরিয়াভিত্তিক। পদ্মা ব্যাংক সাধারণ হলেও আমরা (এক্সিম) যেহেতু তাদের মার্জ করেছি তাই তারাও শরিয়াভিত্তিক হবে। এক্সিম ব্যাংকের প্রতিটি সূচক ভালো অবস্থানে আছে, আশা করব ভালো হবে।

এসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, খেলাপিদের পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুটি অডিট ফার্ম নিয়োগ করা হবে। অডিটের মাধ্যমে পরিচালকদের দায়-দেনাও উঠে আসবে। আইনি প্রক্রিয়া ফলো করে আমরা সামনের দিকে আগাবো। যত দ্রুত সম্ভব দুটি ব্যাংকে মার্জ করে ঘোষণা দেওয়ার পর পদ্মা ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকে পরিণত হবে। তখন চাইলে এই ব্যাংকের গ্রাহক এক্সিম ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মুখপাত্র বলেন, কোনো ব্যাংক এখনো দেউলিয়া হয়নি। ব্যাংকের পর্যায়ে কাজ শেষ হলে আদালত এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কিছু কাজ আছে। এসব প্রক্রিয়া শেষ হলে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে জানানো হবে।

এক্সিমের পদ্মা ব্যাংকের একীভূতের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় আমানতকারীদের মধ্যে। আলোচনা চলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। বিপদগ্রস্ত ব্যাংক পদ্মার সব দায়-দায়িত্ব এক্সিম ব্যাংক নিলে তার ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়েও আমানতকারীদের মধ্যে চলছে আলোচনা।

এছাড়া পদ্মা ব্যাংক চলে প্রচলিত সুদ ব্যবস্থায় এবং এক্সিম ব্যাংক শরিয়াহ ভিত্তিতে। প্রচলিত ব্যাংকের ঋণ ও আমানত সুদহার নির্দিষ্ট করা থাকে। চুক্তি অনুযায়ী আমানতের বিপরীতে সুদ পান আমানতকারীরা। আবার ঋণ নেওয়ার সময় উল্লেখ থাকা হার অনুযায়ী ব্যাংক ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে সুদ নিয়ে থাকে প্রচলিত ধারার ব্যাংক। আর ইসলামি ব্যাংকিং বলতে ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠা ব্যাংকব্যবস্থাকে বোঝায়।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে শিগগিরই একটি নীতিমালা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর কার্যক্রম শুরু হলেও এখনো দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া বাকি আছে।

এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর একটা প্রভাব শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে পড়তে পারে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবু আহমেদ  বলেন, ‘যদি নেট এসেট ভ্যালু নেগেটিভ থাকে তবে এটার দায়িত্ব কে নেবে? যদি এক্সিম ব্যাংক দায়-দায়িত্ব নেয় তবে শেয়ার হোল্ডাররা ঠকবে না? এক্সিম ব্যাংকও তো ততটা সবল ব্যাংক না। যদি মার্জার করতেই হয় পাঁচ বছর আগে যখন সোনালী অগ্রণী জনতা টাকা দিল তখনই তো এই কাজটি করা উচিত ছিল। এখন বলা হচ্ছে, বোর্ডে তারা থাকতে পারবে না, তাহলে তাদের টাকাটার কী হবে? এক্সিম কোথা থেকে টাকা দেবে। শেষ পর্যন্ত এমন না হয় যারা আগে টাকা দিয়েছে তাদের নিরাশ হয়েই থাকতে হয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংক চলে প্রচলিত সুদ ব্যবস্থায় আর এক্সিম ব্যাংক শরিয়াহ ভিত্তিতে। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী নীতির দুই ব্যাংক এক জায়গায় হলে পুরো কাঠামোই বদলে যাবে। পদ্মা ব্যাংকের গ্রাহকের চেয়ে এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা বিষয়টিকে কীভাবে নেবেন, তা বড় প্রশ্ন। বিপরীতে পদ্মা ব্যাংকের কর্মচারীদের তো শরিয়াহ সম্পর্কে ধারণা নেই। তাদেরই বা কীভাবে আত্মীকরণ করবে এক্সিম ব্যাংক? এছাড়াও ব্যাংকিং খাতে যারা সবল, তারা দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিলে প্রত্যাশাটা ভালো করা যায়। এক্সিম ব্যাংক তুলনামূলকভাবে তো পদ্মার চেয়ে ভালো। এখন যেটি হচ্ছে, তার সুফল বা ব্যর্থতা দেখতে আমাদের সময় লাগবে, অপেক্ষা করতে হবে।’

দেশে ২০১৩ সালে নতুন যে নয়টি ব্যাংক অনুমোদন পায়, তার একটি হলো পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স)। শুরু থেকেই এটির কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন অনুমোদন পাওয়ার আগেই ব্যাংকটি অফিস খুলে লোকবল নিয়োগ দিতে শুরু করে। আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন এর উদ্যোক্তারা। ফলে চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি।

পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির এমডি একেএম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। পদ্মা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী নীতির দুই ব্যাংক এক জায়গায় হলে পুরো কাঠামোই বদলে যাবে। পদ্মা ব্যাংকের গ্রাহকের চেয়ে এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা বিষয়টিকে কীভাবে নেবেন, তা বড় প্রশ্ন।

২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। এ রকম অবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পদ্মা। এর ফলে ব্যাংকের তালিকা থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংকের নাম। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর জেলে আছেন নির্বাহী কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী এবং তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতী। গত বছরের অক্টোবরে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় তাদের ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বর্তমানে এটি ইসলামি ধারার একটি ব্যাংক। ২০০৪ সালে এটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ইতোমধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক একীভূত করতে পরিচালক পর্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) প্রকাশ করেছে এক্সিম ব্যাংক।

কোম্পানি সচিব মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, পরিচালক পর্ষদের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের অবহিত করতে পিএসই প্রকাশ করা হয়েছে পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে। গত ১৪ মার্চ এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের ১৮৭তম সভার সিদ্ধান্ত বিজ্ঞাপন আকারে এসেছে গণমাধ্যমে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির ব্যবসায় পরিবর্তন, সংযোজন বা এমন কোনো সিদ্ধান্ত যা আর্থিক প্রতিবেদনে প্রভাব পড়তে পারে ও শেয়ারদরকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন কোনো তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানানোর বাধ্যবাধকতা আছে। একেই মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা পিএসআই বলে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘মূল্য সংবেদনশীল তথ্য’ বিনিয়োগকারী ও স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এজন্য পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টালে বিজ্ঞাপন আকারে ছাপাতে হবে। পরবর্তী কার্যদিবসে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদেরও তা জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

লোকসানি পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণ করায় তার আমানত ও ঋণের দায়, পুঞ্জিভূত লোকসান-সব কিছুই মুনাফায় থাকা এক্সিম ব্যাংকের ওপর পড়বে। এতে করে কোম্পানির ভবিষ্যতের আয়কে কতটুকু প্রভাবিত করতে পারে তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।